উদ্ভিদবিজ্ঞান বলে, সব উদ্ভিদের ফুল ও ফল হয় না। যেসব উদ্ভিদে ফুল হয় না সেগুলোকে বলা হয় অপুষ্পক উদ্ভিদ, বোটানির ভাষায় ক্রিপ্টোগ্যাম। আবার, যেসকল উদ্ভিদে ফুল হয় তাদেরকে সপুষ্পক উদ্ভিদ বা ফ্যানেরোগ্যাম বলা হয়। উদ্ভিদজগতের শ্রেণিবিভাগ বললেই আমাদের মাথায় ছয়টা নাম পরপর চলে আসে। সেগুলো হলো:
- শৈবাল
- ছত্রাক
- মস
- ফার্ন
- নগ্নবীজী
- আবৃতবীজী
আমরা সাধারণত যাদেরকে গাছ বলি,তারা আসলে আবৃতবীজী বা গুপ্তবীজী উদ্ভিদ। অর্থাৎ তাদের ফুল ও ফল দুটিই হয় এবং বীজ ফলের মধ্যে থাকে। নগ্নবীজী উদ্ভিদের মধ্যে একজনকে সবাই চেনে, সাইকাস। সাইকাস আগে মূলত বোটানিক্যাল গার্ডেনে পাওয়া গেলেও এখন অনেকে বাড়ির সজ্জার জন্য মেসোজয়িক যুগ বা সরীসৃপের যুগে উৎপত্তি লাভ করা উদ্ভিদটিকে ব্যবহার করেন। ফার্ন কে ঢেঁকিশাক বললে অনেকেই চিনবেন। শৈবাল হলো ছাদে- বাড়ির দেওয়ালে জন্মানো ‘শ্যাওলা’, আর ছত্রাক হলো মাশরুম,ইস্ট এগুলো।
ক্রিপ্টোগ্যামের মধ্যে শৈবাল, ছত্রাক বাদ দিলে মস ও ফার্নের জন্য দুটো সুন্দর নাম আছে। ব্রায়োফাইটা আর টেরিডোফাইটা। গঠনগত দিক থেকে তারা শৈবাল ও ছত্রাকের তুলনায় উন্নত ও জটিল,তাই এদেরকে হায়ার ক্রিপ্টোগ্যাম বলে।
Table of Contents
আজকে যেহেতু মস নিয়ে কথাবার্তা, তাই আলোচনার আগে মসের বৈশিষ্ট্য সমূহ একটু জেনে নেব। ব্রায়োফাইটার বৈশিষ্ট্যই মূলত মসের বৈশিষ্ট্য।
মসের বৈশিষ্ট্যঃ
- ফুল, ফল ও বীজ হয় না।
- দেহ থ্যালয়েড মানে মূল,কাণ্ড ও পাতায় ভাগ করা যায় না।
- মূল নেই, এর পরিবর্তে এককোষী রাইজয়েড দেখা যায়।
- দেহে কোনো পরিবহন টিস্যু নেই। যেহেতু মূল, কাণ্ড বা পাতা নেই সেহেতু এর দরকারও পড়ে না।
- নিষেকের জন্য জলীয় মাধ্যম প্রয়োজন।
- ফুল নেই বলে স্পোরের মাধ্যমে সকল প্রকার জনন সম্পন্ন করে।
- হ্যাপ্লয়েড জীব, অর্থাৎ প্রতিটি দেহকোষে একসেট ক্রোমোজোম বিদ্যমান।
এই বৈশিষ্ট্য গুলো দেখে আমাদের মনে হতে পারে, মস একটি নিতান্ত অনুন্নত এবং অপ্রয়োজনীয় উদ্ভিদ। সেটি যে সত্য নয় তার একটি উদাহরণ দিই: মসবর্গীয় উদ্ভিদই বিবর্তন ধারায় প্রথম স্থলজ উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে।
মস কোথায় জন্মায়?
যেহেতু মস এক ধরনের উভচর উদ্ভিদ, তার বংশবৃদ্ধির জন্য পানি প্রয়োজন, তাই তার জন্য পর্যাপ্ত পানি রয়েছে এরকম যেকোনো স্থানেই সে জন্মাতে পারে। সেই স্থান হতে পারে গাছের বাকল, গুঁড়ি, শিকড়, দেওয়াল, স্যাঁতসেঁতে মাটি, নদীতীরের বালু বা ছোটখাট পুকুর। মস খুবই নিম্ন তাপমাত্রা সহ্য করেও বেঁচে থাকতে পারে বলে এদের তুন্দ্রা অঞ্চলেও দেখা যায়। কোনো কোনো মরুভূমিতেও এদেরকে পাওয়া গিয়েছে। একমাত্র লোনা পানি ছাড়া প্রায় সমস্ত পরিবেশেই মস অভিযোজিত। বিশ্বের সব মহাদেশ মিলিয়ে মসের প্রায় ১২,০০০ প্রজাতি রয়েছে। ‘’ন্যাচার জিওসাইন্স” এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, পুরো স্থলভাগ জুড়ে মসের বিস্তৃতি ৯.৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, আকারে যা প্রায় চীনের সমান।
মসের উপকারিতা :
ভূমিক্ষয় রোধ:
মাটির ক্ষয় রোধ করার জন্য একেবারে প্রথম সারির যোদ্ধা হচ্ছে মস। যেহেতু তাদের পুরো দেহটাই ছড়ানো পাতার মতো, তাই তারা সহজেই পানি শোষণ এবং তা প্রয়োজনমতো ধারণ করতে পারে।
পতিত জমিতে মস, অন্যান্য ব্রায়োফাইট এবং ক্রিপ্টোগ্যাম মিলে মাটির উপর বায়োলজিক্যাল সয়েল ক্রাস্ট তৈরি করে। খালি জমিন, যেখানে কোনো গাছপালা নেই সেখানে ভারী বা অতিভারী বর্ষণের সময় মাটি ধুয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। মস তা ঘটতে দেয় না। অনেকগুলো মসবর্গীয় উদ্ভিদ একটা চাদরের মতো পুরো এলাকা আবৃত করে রাখে যাতে মাটির জৈব ও অজৈব উপাদান থেকে যেতে পারে। এক ধরনের মসই আছে যাদের নাম Carpet moss বা Sheet moss। এদেরকে বিভিন্ন ঢালে অথবা প্রায়ই বৃষ্টি হয় এমন স্থানে পাওয়া যায় বা কৃত্রিমভাবেও রোপণ করা হয়।
পরিবেশ দূষণের সূচক:
অনেকসময় পরিত্যক্ত শস্যক্ষেত বা শিল্প এলাকার আশেপাশের পতিত জমিতে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও ভারী ধাতু জমা হয়। বৃষ্টির পানির সাথে মাটি ধুয়ে যাবার সময় এসব পদার্থও নিকটবর্তী জলাশয়ে গিয়ে পানি দূষণ করতে পারে। মস এই পদার্থগুলোও শোষণ করে নেয়। এভাবে তারা পরিবেশ দূষণের সূচক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ দূষিত অঞ্চলে এদেরকে কম পাওয়া যাবে।
কার্বন শোষণ:
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে ব্রায়োফাইট মসেরা এভাবেই কাজ করে। সালোকসংশ্লেষণের জন্য তারা পরিবেশ থেকে প্রচুর কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে নেয় এবং তা তাদের দেহে বায়োমাস হিসেবে সঞ্চিত থাকে । ৬০ সে.মি. দৈর্ঘ্য এবং ৮০ সে.মি. প্রস্থজুড়ে থাকা মসের স্তর এক কিলোগ্রাম কার্বন প্রসেস করতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে মসের মতো ছোট উদ্ভিদের এ কাজ গুরুত্বপূর্ণ নাও মনে হতে পারে। কিন্তু এভাবে তারা বছরের পর বছর সেই কার্বন নিজেদের দেহে জমা রাখতে পারে, যদি পরিবেশের কোনো পরিবর্তন না ঘটে। ‘ন্যাচার’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, বিশ্বজুড়ে, স্থলজ মস মাটিতে প্রায় ৬.৪৩ গিগাটন ( ৬.৪৩ বিলিয়ন মেট্রিক টন) কার্বন ধারণ করে। এই পরিমাণ বৈশ্বিক কার্বন নি:সরণের ( কৃষিকাজ, খনিজ সম্পদ আহরণ, নগরায়ণ প্রভৃতি) ছয় গুণ।
শুধু কার্বন নয়, মস বায়ু থেকে সালফার ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইড গ্যাস শুষে নিয়ে বায়ুকে পরিশুদ্ধ করে। আবার জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহনের ফলে যে কণা তৈরি হয় ( soot particle), মস সেগুলোও পরিশোধন করতে পারে। প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের উপর সুট পার্টিকেলের প্রভাব কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে ১৮০০ গুণ বেশি।
পানি বিশুদ্ধিকরণ :
ব্রায়োফাইটা বর্গের এই উদ্ভিদরা প্রাকৃতিক ওয়াটার ফিল্টার হিসেবে কাজ করে। যেহেতু তারা উভচর, তাই তারা থ্যালয়েড দেহের মাধ্যমে প্রচুর পানি শোষণ করতে পারে। খরা ও মরুভূমির মতো পানিস্বল্পতার পরিবেশে টিকে থাকার জন্য তাদের দেহের অভিযোজন এভাবেই ঘটেছে। পানির দূষক পদার্থ, ভারী ধাতু এসব মসের দেহে আটকে যায় এবং বিশুদ্ধ পানি তাদের দেহের বিভিন্ন ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে আসে। এভাবে মস বিভিন্ন মিঠাপানির উৎসকে ব্যবহারযোগ্য রাখে।
মসের এই বৈশিষ্ট্যকে বিভিন্ন জায়গায় কাজে লাগানো হয়। অনেক জায়গায় স্পা আর সুইমিংপুলের পানি পরিষ্কার করতে ক্লোরিন আর সিলভারের পরিবর্তে পিট মস নামক এক ধরনের মস ব্যবহার করা হয়। ফিল্টারিংয়ের সময় মস:
- ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও শৈবালের বৃদ্ধি প্রতিহত করে।
- পানি থেকে ম্যাগনেসিয়াম, মার্কারি (পারদ), লৌহ ও ক্যালসিয়ামের আয়ন সরিয়ে ফেলে।
- pH নিয়ন্ত্রণ করে।
পানি ধারণ:
তাদের সক্ষমতার জন্য মস একই সাথে অনেক পানি শোষণ করতে পারে তা আগেই বলা হয়েছে। এই পানি তারা ধীরে ধীরে মাটি ও তা সংলগ্ন পরিবেশে ছেড়ে দেয়। লম্বা সময় ধরে পানি ধরে রাখতে পারার এ বৈশিষ্ট্য খরাপীড়িত বা শুষ্ক মাটির জন্য খুবই উপকারী। এজন্য শুষ্ক অঞ্চলের জমিতে মস রোপণ করা ভালো। এতে করে ঐ জমিতে মাটি পরিমাণ মতো আর্দ্র থাকবে। গাছপালা লাগালে আগের মতো বেশি পানি দেওয়ার দরকার পড়বে না। এছাড়া মসের প্রস্বেদনের কারণে সেখানকার আর্দ্রতাও বৃদ্ধি পাবে।
বাস্তুতন্ত্রের উন্নতি:
মস কিছু ছোট ছোট বাস্তুতন্ত্রের সূচনা করতে পারে। কারণ তারা মাটিতে পানির পরিমাণ বাড়ায়, বাতাসকে পরিশুদ্ধ করে এবং কার্পেটের মতো ছড়িয়ে থেকে বহু ছোট প্রাণীকে আশ্রয় দিতে সক্ষম। বিভিন্ন অণুজীব, অমেরুদণ্ডী প্রাণী, পোকামাকড় এমনকি ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর সমন্বয়ে মস বাস্তুতন্ত্র গঠন করতে পারে, যেখানে সে উৎপাদকের কাজ করে। এভাবে মস বিভিন্ন প্রজাতির আশ্রয়স্থল হয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অবদান রাখে।
শিলা ভেঙ্গে মাটি গঠন:
শুধু মস নয়, লাইকেনেরও এ বৈশিষ্ট্য আছে। তাদের দেহ থেকে জৈব অ্যাসিড নি:সৃত হয় যা কঠিন শিলাকে ভাঙতে থাকে। পরবর্তীতে মস মাটিতে পুষ্টি উপাদান যোগ করে একে অন্যান্য উদ্ভিদ বা প্রাণী বসবাসের উপযোগী করে তোলে।
মানুষের জন্য মস:
পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি মস মানুষেরও অনেক কাজে লাগে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চিকিৎসা কাজে। বলা হয়, ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ান চিকিৎসকরা ক্ষতে ব্যান্ডেজ এবং মস দুটিই ব্যবহার করতেন। এশিয়াতেও ত্বক, চোখ এবং যকৃতের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় মসের ব্যবহারের কথা জানা যায়। একাজে মসের পাশাপাশি অন্যান্য ব্রায়োফাইট দেরও ব্যবহার করা যায়। ইনডোর মস অতিরিক্ত আর্দ্রতা শোষণ করে বিষণ্ণতার ঝুঁকি কমায়।
ইনডোর মস প্ল্যান্টিং:
বাড়ির ভিতরে মানিপ্ল্যান্ট, স্নেকপ্ল্যান্ট বা এরিকা পামের মতো মসও লাগানো যায়! এজন্য লাগবে টেরারিয়াম, অথবা বড়সড় কাঁচের জার। কোনো সার প্রয়োজন নেই, নিয়মিত পানিও দিতে হবে না।
কীভাবে ইনডোর মস প্ল্যান্টিং করবেন তা বিস্তারিত জানুন এখানে।
মসের এত কার্যকারিতার রহস্য কী?
মসের বেশিরভাগ গুণাগুণ নির্ভর করে তাদের উচ্চ শোষণক্ষমতার উপর। তারা অনেক বেশি শোষণক্ষম কারণ:
- মসের কোষপ্রাচীরে লিগনিন জমা হয়ে পুরু হয় না। তাই এদের বহির্ভাগ দৃঢ় ও ভঙ্গুর থাকে না।
- দেহে কিউটিকলের (এক ধরনের মোমজাতীয় আবরণ) আবরণ উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত।
শেষ কথা:
মস আগাছা হিসেবে বাগানে জন্মায়। বিভিন্ন ঝোপঝাড়েও দেখা যায়। কিন্তু মস ততোটাও ফেলনা নয় যতটা আমরা তাকে ভাবি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ও মানবকল্যাণে এই ব্রায়োফাইটের অবদান অনস্বীকার্য। তাই মসকে ব্যবহার করে এয়ার আর ওয়াটার পিউরিফায়ার তৈরি করার চিন্তা করাই যায়। এছাড়াও, বিভিন্ন পতিত জমিতে পরিকল্পিতভাবে মস লাগিয়ে সেগুলোকে চাষবাসের উপযোগীও করা যেতে পারে।