অনলাইন ক্যাসিনো যেভাবে ভার্চুয়াল দুনিয়ার অন্যতম ক্যান্সার

প্রাচীন কালের জুয়াখেলা যখন ভার্চুয়াল জগতের বেটিং সাইট বা ক্যাসিনোতে আসন গেড়ে বসে, তখন তা আর বেশি মানুষকে আকর্ষণ করে আর দুঃসহ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে আনাচে কানাচে এই অনলাইন ক্যাসিনো ছড়িয়ে পড়ার কারণে অনলাইন জগতের সমস্যা বাস্তবজীবনেও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। সেই সমস্যার স্বরূপ তুলে ধরাই আজকের মূল লক্ষ্য। সমাধানটা বলা সহজ, বাস্তবায়ন করা কঠিন।

সাম্প্রতিক কিছু রিপোর্টঃ

SEMRUSH এ একটা রিপোর্ট দেখলাম। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে মোস্ট ভিজিটেড গ্যাম্বলিং বা অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইটের তালিকা। তালিকায় শীর্ষস্থান দখল করেছে যে ওয়েবসাইট ( সঙ্গত কারণেই নাম বলব না) সেটিকে ভিজিট করেছেন ১.১৪ মিলিয়ন বা ১১ লাখ ৪০ হাজার ব্যবহারকারী। এর মধ্যে ডেস্কটপ কম্পিউটারের ব্যবহারকারী মাত্র ০.৩১% , সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৩.৫৪ হাজার। আর বাদবাকি সবাই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্যাম্বলিং সাইটটিতে প্রবেশ করেছেন। জুনের তুলনায় জুলাইয়ে ব্যবহারকারী বেড়েছে ১৪.১% আর গত বছরের জুলাই এর তুলনায় এবছরের জুলাইয়ে ৪৩৪৪.২%। মেইন ট্রাফিক সোর্স ডিরেক্ট অর্থাৎ ব্যবহারকারীরা ওয়েবসাইটের ডোমেইন ধরেই গুগলে সার্চ করেছেন।

গুগল ট্রেন্ডস এর বাংলাদেশ অংশেও নিজেদের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে ক্যাসিনো আর ক্রিকেট বেটিং সাইটগুলো। শীর্ষ সার্চ টপিক একটি বেটিং সাইটের দখলে, যার বিজ্ঞাপনে প্রায়ই কিছু বিখ্যাত খেলোয়াড়দের দেখা যায়।

গত ১৩ জুন জাতীয় মনিটরিং ও ট্র্যাকিং সেল থেকে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশে ৫৭৫ টিরও বেশি অনলাইন গ্যাম্বলিং এর সাইট চালু রয়েছে। তারা বিভিন্ন ধরনের জুয়া খেলার সুযোগ দেয় – ক্রিকেটের জুয়া থেকে শুরু করে ক্যাসিনো পর্যন্ত।

এবার প্রথম আলোর খবর। গত ৭ আগস্ট রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে আয়শা আক্তার তানিশা (২৪) নাম্নী এক নারীর। তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলেন তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর পরিবারের দাবি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে এবং সে জন্য তাঁরা হত্যা মামলাও দায়ের করেছেন। তিনটি কন্যাসন্তানের মা আয়শার শ্বশুরবাড়ির আর্থিক অবস্থা মন্দ নয়। নিজেদের বাড়িতেই থাকতেন। কিন্তু স্বামী ছিলেন অনলাইন গেমসে আসক্ত। বিভিন্ন দফায় আয়শার পরিবার থেকে টাকা নিতেন এবং সংসারে এ নিয়ে ব্যাপক অশান্তি হতো। শেষ পর্যন্ত আয়শাকে তো নিজের জীবনই দিতে হলো। সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

এরকম ন্যারেটিভ নিশ্চয়ই উপর্যুক্ত এগারো লাখ মানুষের অনেকের ঘরে পাওয়া যাবে। জানা যাবে শত শত রায়হানের ( আয়শার স্বামী) এরকম আসক্তির কথা, এবং আয়শাদের চাপা কান্নার কথা।

এখন কথা হচ্ছে এই যে অনলাইন ক্যাসিনো বা গ্যাম্বলিং এর আসর যে মাদকের মত বাংলাদেশে তার থাবা বসাচ্ছে, তা তো স্পষ্ট। মাদক যেমন সাময়িক আনন্দ বা কারো ভাষায়, ‘স্বর্গবাসের’ সুযোগ করে দেয়, গ্যাম্বলিং ও স্বল্প পরিসরে ব্যবহারকারীকে লাভ করায়। দিনশেষে সুখ বা টাকা কোনোটাই থাকে না। ঠেলে দেয় হতাশা, বিষণ্ণতা আর আক্রমণাত্মক আচরণের দিকে। আরো আনন্দের আশায় মাদকসেবী যেমন সেবনমাত্রা বাড়িয়ে দেয়, গ্যাম্বলিং এ আসক্ত ব্যক্তিও লাখপতি, কোটিপতি হবার আশায় যে লাভ পেয়েছিল তা বিনিয়োগ করে। মূল লাভটা যায় এই জুয়ার সাইটগুলো যারা পরিচালনা করে, তাদের পকেটে।

গত ৩ জুন ডিসমিস ল্যাবের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ সরকারের নিবন্ধিত এগারোটি ডোমেইনের সহায়তায় চারটি জুয়ার সাইট ব্যবহারকারীদের তাদের সাইটে নিয়ে যেত। সে ব্যাপারে আজও কোনো সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থা কোনোটিই গৃহীত হয়নি। এখনো ক্যাসিনোগুলোর বিজ্ঞাপন দেওয়া সেই ওয়েবপেজ গুলো দৃশ্যমান। প্রাথমিক সার্চে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, Bangladesh Journal of Administration and Management, ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার ২০২২, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমি, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড এবং ঢাকা ডেন্টাল কলেজ জার্নাল এর ওয়েবসাইটে ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপনের পেজ দেখা গেছে। সংশ্লিষ্ট সাইটগুলোর ডেভেলপাররা এ ব্যাপারে অজ্ঞ বা উদাসীন বলে বোধ হয়। সিলেট রেঞ্জের পুলিশের ওয়েবসাইটেও ক্যাসিনো নিয়ে আর্টিকেল লেখা দেখা গিয়েছে।

জুয়া বা ক্যাসিনো সাইট গুলো মানুষিকে ক্রমাগত আসক্ত করে চলেছে।
ক্যাসিনোর প্রলোভন মানুষকে বেঁধে ফেলে।

মানুষ কেন সরাসরি জুয়া খেলতে সরাসরি ওয়েবসাইটে চলে যায় ?

কারণ এই গ্যাম্বলিং বা ক্যাসিনো সাইটগুলো এত আকর্ষণীয় ও লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেয় যে, তা ক্লিক করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। বিজ্ঞাপনগুলো হয়ই এরকমঃ আপনার একাউন্টে এত (বেশ বড় এমাউন্ট, ৫০-৮০ হাজার ) টাকা জমা হয়েছে। যেখানে মানুষ হাজার হাজার বার অনলাইনে বিনা পরিশ্রমে এবং বিনা খরচে টাকা উপার্জনের পদ্ধতি গরুখোঁজা করে, সেখানে কেউ একটু সতর্ক না হলে সহজেই এই ফাঁদে পড়বে তা আর বলতে! দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আইপিএল, বিপিএল,বিশ্বকাপ প্রভৃতি টুর্নামেন্টে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো বাংলাদেশেও লাখ লাখ টাকার জুয়াখেলা হয়। এমনকি টফির মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে দেখা গেছে। কীভাবে বেটিং সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে, কীভাবে ক্যাসিনো খেলতে হবে, ক্যাসিনো জেতার কৌশল এমন অনেক টিউটোরিয়ালও রয়েছে জুয়াড়িদের জন্য।

বাংলাদেশে জুয়ার আইনঃ

ব্রিটিশ আমলের যে আইন এখনো বিদ্যমান, তা খুবই হাস্যকর। জুয়া খেলে ধরা পড়লে জরিমানা পঞ্চাশ টাকা মাত্র। কালের প্রবাহে এই শাস্তি মোটেই উপযুক্ত নয় বয়লে ২০১৯ সালে ক্যাসিনো অভিযানের পর হাইকোর্ট জুয়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। ২০২৩ সালে নতুন আইন করার কথা থাকলেও তা আর বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ আইনে শাস্তি হতো সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

অনলাইন জুয়া বা ক্যাসিনো খেলা কি বড়লোক করতে পারে?

উত্তরটা একজন প্রফেশনাল জুয়াড়ি থেকেই জানুন। জিম মাকোস প্রায় ২০ বছর ধরে প্রফেশনাল গ্যাম্বলিং করেন এবং নিজেকে একজন উদ্যোক্তা বলে পরিচয় দেন। নিজের ওয়েবসাইটে তিনি লেখেন, “প্রায় ৯০% জুয়াড়িই ব্যর্থ হয়। ৫% লোক সবসময় লাভ করতে পারে এবং মাত্র ১% জুয়াড়ি বছরের পর বছর জুয়া খেলে একে নিজের আয়ের উৎসে পরিণত করতে পারে।” সবাই ভাবে, সেই হবে কাঙ্ক্ষিত ১% এর মধ্যে একজন। এই ১% এর পোর্টফলিও ৯৯% এর সামনে রেফারার (যে অন্যকে জুয়া খেলতে প্ররোচিত করে) এমনভাবে উপস্থাপন করে, যাতে করে মানুষ ওই ১% লোকের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে নেয়। অন্যকে এই চক্রে যুক্ত করতে পারার জন্যও রয়েছে বোনাস।

কীভাবে টাকা পাচার হয়?

সহজ সরল মানুষকে বেটিং সাইটে টানার জন্য বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি সাইট মালিকরা জনবল নিয়োগ করে। যাদের কাজ মানুষকে প্ররোচিত করে এপথে আনা থেকে সর্বনাশের রাস্তা পর্যন্ত সযত্নে পৌঁছে দেওয়া এবং তারপর ‘বাটপার’ ট্যাগ নিয়ে গায়েব হয়ে যাওয়া । তারা মানুষের কাছ থেকে বাজির অর্থ সংগ্রহ করে তা সংশ্লিষ্ট সাইটের বিদেশের অ্যাকাউন্টে জমা করা। যেহেতু সিংহভাগ হেরে যায়, ঐ অর্থ আর দেশে ফেরত আসে না এবং এভাবেই পাচার হয়ে যায়।

মানুষ কেন গ্যাম্বলিং করে?

বদঅভ্যাস:

অনেকের জীবনে স্বচ্ছলতা থাকার পরও এরকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়াতে বাঁধে না। একবার জুয়া খেলা শুরু করলে তা আর সহজে ছাড়া যায় না। জুয়ার মার্কেট পুরোটাই প্রলোভনের উপর প্রতিষ্ঠিত। গরিব মানুষকে বিনা পরিশ্রমে টাকা উপার্জনের প্রলোভন আর ধনীদেরকে ঝুঁকি আর অ্যাডভেঞ্চারের প্রলোভন। মানুষ যেমন সিগারেট খেলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হবে জেনেও তা খায়, তেমনি জুয়ায় সর্বস্ব হারাতে হতে পারে জেনেও জুয়াড়িরা ক্ষীণ আশায় বুক বেঁধে বেট করে। গরিব মানুষ উপরি লাভের আশায় বেটিং সাইটে আসে। আর ধনীদের ব্যাপার-স্যাপার আলাদা। তাদের টাকা আছে, জীবনে সব ভোগ-বিলাসের উপকরণ আছে, খালি রোমাঞ্চ নেই। বেশিরভাগ সময়ে সেটার সন্ধান পেতেই তারা গ্যাম্বলিং সাইটে প্রবেশ করে।

গ্যাম্বলিং ডিজঅর্ডার:

জুয়া আমাদের ব্রেনের রিওয়ার্ড সিস্টেমের উপর প্রভাব ফেলে। এর ফলে আমরা যে কাজই করি না কেন তা করতে আমাদের খুবই ভালো লাগে এবং এর মধ্য দিয়ে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে যে ডোপামিন নিঃসরণ হয় তা আমাদের মধ্যে একধরনের সন্তুষ্টির জন্ম দেয়।

ব্লুফিল্ম বা মাদকের মতো এই ক্যাসিনো, বেটিং সাইটগুলো আমাদের সমাজকে অস্থিতিশীল করে দিচ্ছে। টাকা হেরে মানুষ আবার টাকা জোগাড় করে বেটিং এর জন্য ছুটে যাচ্ছে। টাকা না থাকলে ধারদেনা করছে। স্ত্রীর শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে বলছে, না আনলে চলছে নির্যাতন। নিজের পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করছে। ধারদেনার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে গোপনে বা প্রকাশ্যে নিজের বা পরিবারের মূল্যবান সামগ্রী বিক্রি করে দিচ্ছে। মানুষ নেশাগ্রস্ত হলে তাকে দেখে বোঝা যায়। কিন্তু ক্যাসিনো-আসক্ত দের দেখে চেনার উপায় আছে কি?

মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এখন মানুষের হাতের মুঠোয় দুনিয়া এনে দেওয়ার পর মানুষ এখন সহজেই সবকিছু পেতে চায়। কিন্তু অনলাইন বা অফলাইন, কোনো জায়গাতেই বিনা পরিশ্রমে টাকা উপার্জনের কোনো সু্যোগ নেই, তা তাদেরকে বোঝানো দরকার। প্রমথ চৌধুরী একটা কথা বলেছিলেন, “ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।” অর্থাৎ কষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত হবার চেয়ে একটু ‘লেফট রাইট’ করে, অমুকের কাছে ‘অনলাইন গেমস’ শিখে ইনকাম করার ধারণা অনেক বেশি চমকপ্রদ।

এখন করণীয়?

নতুন যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করে বেটিং সাইট নিষিদ্ধ করলেও তেমন ভালো ফল হবে না। কারণ ছেলে বুড়ো সবাই এক আলাদিনের চেরাগের সন্ধান জানে- তার নাম ভিপিএন। তবে আইনটি প্রণয়ন করা দরকার। যাতে কোনো জুয়াড়ি ধরা পড়লে তাকে দণ্ডদান করা যায়। মানুষকে এ থেকে নিরুৎসাহিত করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য বেশি বেশি পাব্লিক কাউন্সেলিং করতে হবে।

ধর্মীয় চেতনাও এক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। ইসলাম সর্বপ্রকার জুয়া হারাম বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর বিস্তারিত নিয়ে একটি লিংক প্রোভাইড করলাম। এখানে ক্লিক করলে তা দেখা যাবে।

এছাড়া বিলবোর্ড ও টেলিভিশন চ্যানেল গুলোয় ক্যাসিনো বিরোধী বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হবে। আর ক্যাসিনো, স্পোর্টস বেটিং বা গ্যাম্বলিং এর বিজ্ঞাপনও যথাসম্ভব বন্ধ করা উচিত। মানুষের সচেতনতাই এক্ষেত্রে মুখ্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top