কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, লিপিড – দৈনন্দিন জীবনে খাদ্য তালিকায় উপস্থিত এই তিন ধরনের জৈবঅণু আমাদের দেহের শক্তির চাহিদা পূরণ করে।
লিপিড কে সবাই ফ্যাট নামে চিনবে, কিন্তু ফ্যাট আর লিপিড এক নয়। ফ্যাট ছাড়াও লিপিডের অনেক যৌগ আছে, ফ্যাট একটা শ্রেণি মাত্র। ফ্যাট আবার দুটি ভৌত অবস্থায় থাকতে পারে – তেল ও চর্বি। কক্ষ তাপমাত্রায় অর্থাৎ ২৫° সেলসিয়াসে যদি তরল থাকে, তাহলে তা তেল আর যদি কঠিন থাকে, তাহলে চর্বি।
আমাদের সুষম খাদ্য তালিকায় যে স্নেহ উপাদান রাখতে বলা হয়, তা কিন্তু শক্তি দেবার জন্য নয়। কার্বোহাইড্রেটই শক্তি দেওয়ার মূল কাজ করে থাকে, প্রোটিন তাতে সামান্য পরিমাণে (১০%) অংশগ্রহণ করে। শরীরে কার্বোহাইড্রেট পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকলে তা প্রোটিন ও ফ্যাট স্পেয়ারার হিসেবে কাজ করে অর্থাৎ তাদেরকে জারিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ কমে গেলে ( উপবাস বা রোজার সময়) তখন দেহে সঞ্চিত কার্বোহাইড্রেট (গ্লাইকোজেন) আগে ভাঙ্গে, তারপর ফ্যাট। অর্থাৎ আমাদের খাদ্য তালিকায় ফ্যাট হিসেবে যেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, সেগুলোকে অবশ্যই অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি এসিড এর উৎস হতে হবে।
ফ্যাটি অ্যাসিডের আরেক নাম জৈব এসিড, অর্থাৎ হাইড্রোকার্বনের এক প্রান্তে কার্বক্সিল গ্রুপ থাকে। দুর্বল অ্যাসিড, pK সাধারণত ৩-৫ হয়ে থাকে। কোনো অ্যাসিডের pK ২-৫০ হলে তাকে দুর্বল এসিড বলা যায়। যেহেতু ফ্যাটি এসিড দুর্বল, তাই সে খুব বেশি আয়নিত হতে পারে না।
ফ্যাটি এসিডের শ্রেণিবিভাগঃ
ফ্যাটি এসিডকে অনেক ভাবে ভাগ করা যায়। যেমন:
হাইড্রোকার্বন চেইনে ডাবল বন্ডের উপস্থিতি উপর ভিত্তি করে:
- সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড (Saturated Fatty Acid) : ডাবল বন্ড থাকে না।
- অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড (Unsaturated Fatty Acid) : এক বা একাধিক ডাবল বন্ড থাকে।
অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের ডাবল বন্ডের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপরের দুই পাশে হাইড্রোজেন আর নিচের দুই পাশে অন্য মূলক থাকে। যেহেতু ডাবল বন্ড রয়েছে, তাই তারা সিস-ট্রান্স বা জ্যামিতিক সমাণুতা প্রদর্শন করে। প্রাকৃতিক ভাবে বিভিন্ন উৎস থেকে যেসব অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায় তার সবই সিস ফর্মে থাকে। সিস ফর্মে থাকার দরুন তাদের বন্ধনগুলো প্রায় ১২০° কোণে বেঁকে যায়। তাদের বন্ধনগুলো বেঁকে থাকার কারণে অণুগুলো পরস্পর থেকে বেশ দূরত্বে অবস্থান করে, কক্ষ তাপমাত্রায় তারা তখন তরল অবস্থায় থাকতে পারে। একারণেই তেল তরল হয়, কারণ তাতে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। আবার, আমাদের কোষঝিল্লিতে যে ফসফোলিপিড বা গ্লাইকোলিপিড থাকে, সেখানে লিপিড অংশে এই অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডগুলোকেই পাওয়া যায়। তাদের মলিকুলার প্যাকেজিং টাইট হয় না বলে কোষঝিল্লির তারল্য বজায় থাকে, এটা একেবারে শক্ত হয়ে যায় না।
হাইড্রোকার্বন চেইনে সব সিগমা বন্ড থাকলে সেই ফ্যাটি এসিডকে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড বলা হয়। যেহেতু তাদের ডাবল বন্ড থাকে না, তাই তাদের অণুগুলো অনেক কাছাকাছি থাকে। অর্থাৎ কক্ষ তাপমাত্রায় তারা কঠিন থাকে এবং তাদেরকে চর্বি বলে। সব উদ্ভিজ্জ তেল তেল হলেও নারকেল তেলকে চর্বির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কারণ এতে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড বেশি থাকে।
অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডকে দ্বিবন্ধনের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
- মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (MUFA) : তাদের হাইড্রোকার্বন চেইনে একটা মাত্র দ্বিবন্ধন থাকে। যেমন : অলিয়িক এসিড, পামিটোলিক এসিড। এদেরকে অলিভ তেল ও ক্যানোলা তেলে পাওয়া যায়।
- পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড (PUFA) : তাদের হাইড্রোকার্বন চেইনে একাধিক ডাবল বন্ড থাকে। যেমন:
লিনোলিক এসিড : দ্বিবন্ধনের সংখ্যা ২।
লিনোলিনিক এসিড : দ্বিবন্ধনের সংখ্যা ৩।
অ্যারাকিডোনিক এসিড : দ্বিবন্ধনের সংখ্যা ৪।
টিমনোডোনিক এসিড : দ্বিবন্ধনের সংখ্যা ৫।
PUFA আর MUFA দুটোই আমাদের শরীরের জন্য ভালো হলেও MUFA বেশি ভালো। কেননা PUFA গুড আর ব্যাড কোলেস্টেরল দুটোকেই কমায়। আর MUFA শুধু ব্যাড কোলেস্টেরলকে কমায় আর গুড কোলেস্টেরলকে বাড়ায়।
এই পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিডগুলোই অত্যাবশকীয় ফ্যাটি এসিড হিসেবে মানুষকে খেতে বলা হয়। এগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় এজন্য বলা হয় যে, শরীরের অভ্যন্তরে এগুলো তৈরি হয় না। খাবারের মাধ্যমে গ্রহণই এদের অভাব পূরণের একমাত্র উপায়।
ফ্যাটি এসিড কী কাজ করে ?
ফ্যাটি এসিড থেকে ইকোসানয়েড তৈরি হয় যা আমাদের দেহে বিভিন্ন লোকাল হরমোনের মতো কাজ করে। যেমন: প্রোস্টাসাইক্লিন রক্তনালি প্রসারণের কাজ করে, প্রোস্টাগ্লান্ডিন অনৈচ্ছিক পেশি সংকোচন প্রসারণের কাজ করে আর থ্রমবোক্সেন অণুচক্রিকাকে সক্রিয় করে রক্ত জমাট বাঁধাতে সাহায্য করে। হরমোনের মতো কাজ করলেও এরা আসলে হরমোন নয়। কারণ তারা রক্ত দ্বারা বাহিত হয়ে দূরবর্তী স্থানে কাজ করার পরিবর্তে উৎসের কাছাকাছি কাজ করে।
অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড ওমেগা নাম্বারিং এর মাধ্যমেই বেশি পরিচিত। উপরে উল্লিখিত লিনোলিক ও অ্যারাকিডোনিক এসিড ওমেগা – ৬ আর লিনোলিনিক এসিড ওমেগা – ৩ ফ্যাটি এসিড নামে পরিচিত। ডিমের কুসুম, মাছের ভিসেরার তেল, গাঢ় সবুজ শাকসবজি, সয়াবিন, বাদাম, লিনসিড তেলে এগুলো পাওয়া যায়। ভালো কোলেস্টেরল বাড়ানোর মাধ্যমে ফ্যাটি এসিডগুলো কোলেস্টেরল বিপাকে সাহায্য করে। ভালো কোলেস্টেরল বা HDL (Low Density Lipoprotein) বিভিন্ন টিস্যুতে জমা কোলেস্টেরলকে যকৃতে বহন করে নিয়ে আসে এবং পিত্তের মাধ্যমে নিষ্কাশনে সাহায্য করে। এভাবে কোলেস্টেরল কমানোর ফলে রক্তনালিকায় কোলেস্টেরল জমে অ্যাথারোস্ক্লেরেসিস বা প্লাক তৈরির সম্ভাবনা কমে যায়।
এছাড়া অত্যাবশকীয় ফ্যাটি এসিডের অভাবে ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক হয়ে ফ্রাইনোডার্মা বা টোড স্কিন রোগ হয়। কারণ ফ্যাটি অ্যাসিড গুলো ত্বকের ওয়াটার ব্যারিয়ার হিসেবে কাজ করে।
ট্রান্স ফ্যাট কী?
অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডকে হাইড্রোজেন সহযোগে সম্পৃক্ত করার সময় ট্রান্স ফ্যাটি এসিড উৎপন্ন হয়। ট্রান্স ফ্যাটি এসিড গ্লিসারলের সাথে এস্টার তৈরি করে ট্রান্স ফ্যাট গঠন করে। উদ্ভিজ্জ তেল থেকে মার্জারিন তৈরির সময় এ ঘটনা ঘটে। আবার বেকারি সামগ্রী তৈরির সময়ও সেগুলোতে প্রচুর ট্রান্স ফ্যাট তৈরি হয়। ট্রান্স ফ্যাট সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের মতোই আচরণ করে, অর্থাৎ দেহে চর্বি হিসেবে জমতে থাকে।
Pingback: আপনি কি স্থূলতায় আক্রান্ত? জেনে নিন এর কারণ ও প্রতিরোধ - The Unspecified Chronicle