আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে সেখানে অণুচক্রিকা সক্রিয় হয়ে প্লাগ তৈরি করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে, যদি ছোটোখাটো কাটা হয়। রক্তবাহিকা বেশি কেটে গেলে তখন রক্ত জমাট বাঁধা শুরু হয়। সুস্থ মানুষের রক্তক্ষরণ কাল (ব্লিডিং টাইম) ১-৬ মিনিট এবং রক্ত জমাট বাঁধার সময় (ক্লটিং টাইম) ৬-১০ মিনিট। এই সময়সীমা বিলম্বিত হলে বুঝতে হবে যে, কোনো না কোনো কারণে রক্ত ঠিকমতো জমাট বাঁধছে না ফলে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। সব ধরনের অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণকে এক কথায় ব্লিডিং ডিজঅর্ডার বলা হয়। ব্লিডিং ডিজঅর্ডার তিনভাবে হতে পারে, রক্তবাহিকার প্রাচীরে অস্বাভাবিকতা, অণুচক্রিকার সংখ্যাহ্রাস বা ঠিকমতো না কাজ করা আর রক্ত জমাট বাঁধতে ব্যর্থ হওয়া। শেষেরটিকে কোয়াগুলেশন ডিজঅর্ডারও বলা হয়ে থাকে।
Table of Contents
রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া:
অণুচক্রিকা থেকে থ্রম্বোপ্লাস্টিন বের হয়, যা রক্তের প্লাজমা প্রোটিন প্রোথ্রম্বিনকে থ্রম্বিনে পরিণত করে। থ্রম্বিন এনজাইমের মতো কাজ করে আরেক প্লাজমা প্রোটিন ফাইব্রিনোজেনকে ফাইব্রিন মনোমারে পরিণত করে। ফাইব্রিন মনোমার থেকে ফাইব্রিন পলিমারের জালক তৈরি হয় যা ক্ষতস্থানে রক্তকণিকা ও প্রোটিনকে আটকে ফেলে ক্লট তৈরি করে। এই কাজগুলো ঠিকমতো না হলেই কোয়াগুলেশন ডিজঅর্ডার দেখা দেয়।
কোন কোন টেস্ট করে ব্লিডিং ডিজঅর্ডার শনাক্ত করা যায়?
ব্লিডিং ডিজঅর্ডারগুলো শনাক্ত করার জন্য কিছু স্ক্রিনিং টেস্ট করা হয়ে থাকে। প্রত্যেকটির একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে যা দীর্ঘায়িত হলেই রোগ ধরা পড়ে।যেমন:
- ব্লিডিং টাইম (BT) : ১-৬ মিনিট
- ক্লটিং টাইম (CT) : ৬-১০ মিনিট
- অ্যাক্টিভেটেড পার্শিয়াল থ্রম্বোপ্লাস্টিন টাইম (APTT) : ৩২-৪০ সেকেন্ড
- প্রোথ্রম্বিন টাইম (PT) : ১০-১২ সেকেন্ড
- থ্রম্বিন টাইম (TT) : মোটামুটি ১৪ সেকেন্ড
ব্লিডিং ডিজঅর্ডারের নেপথ্যের কাহিনিঃ
রক্তবাহিকার অস্বাভাবিকতা :
রক্তবাহিকার প্রাচীরে কোলাজেন প্রোটিন থাকে, যেটি প্রোকোলাজেন হিসেবে তৈরি হয়। প্রোকোলাজেনকে কোলাজেনে পরিণত করতে হলে চাই ভিটামিন সি। দেহে ভিটামিন সি এর অভাব হলে তখন যথেষ্ট কোলাজেন তৈরি হয় না, ফলে রক্তবাহিকার প্রাচীর ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। তখন স্কিন বা মিউকাস মেমব্রেন বা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ছোট ছোট শিরা বা কৈশিক জালিকা ফেটে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে পারপুরা (purpura)। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণের ফলে যে লাল বা বেগুনি বুটির মতো দেখা যায়, তাকে বলে ব্লচ। এই ব্লচ পারপুরার অন্যতম প্রধান লক্ষণ। এছাড়া দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হতে পারে।
অণুচক্রিকার সংখ্যা কমে গেলেও (থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া) পারপুরা দেখা দিতে পারে। পারপুরার ফলে চামড়ায় যে বিভিন্ন দাগ তৈরি হয়, গ্রামেগঞ্জে অনেকে একে শয়তান বা জ্বিনের আঁচড় মনে করে। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। পারপুরার ক্ষেত্রে ব্লিডিং টাইম বেড়ে যায় কিন্তু ক্লটিং টাইম স্বাভাবিক থাকে।
অণুচক্রিকার সংখ্যাহ্রাস:
অস্থিমজ্জার রোগে (মায়েলোডিসপ্লাস্টিক ডিজঅর্ডার) সব ধরনের রক্তকণিকার সংখ্যা কমে যায়। স্বভাবতই তখন অণুচক্রিকাও কমে যায়। তবে ডেঙ্গুজ্বরেও কমতে দেখা যায়। আবার দেহে অণুচক্রিকার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে, প্লীহার রোগে অধিক অণুচক্রিকা ধ্বংস হলে এবং ব্লাড ট্রান্সফিউশনের পরেও অণুচক্রিকা হ্রাস পায়। প্রতি ঘন মিলিমিটারে স্বাভাবিক প্লেটলেটের সংখ্যা দেড় থেকে চার লক্ষ। এই সংখ্যা ৫০ হাজারের নিচে নামলে তাকে থ্রমবোসাইটোপেনিয়া (অণুচক্রিকার আরেক নাম থ্রমবোসাইট) বলা হয়৷ ৩০ হাজারের নিচে নামলে ব্লিডিং ডিজঅর্ডার আর হেমারেজের (অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ) এর প্রবণতা দেখা যায় এবং ১০ হাজারের নিচে নামলে তাকে প্রাণঘাতী বলে ধরে নেওয়া হয়।
অণুচক্রিকা বা প্লেটলেট গুলো প্রতিদিন আমাদের শরীরের অনেক ক্ষতস্থান পূরণ করে, যেগুলো আমরা প্রায় সময়ই টের পাই না। তারা আগে নিজেরা সক্রিয় হয়ে প্লেটলেট প্লাগ তৈরি করে। এরপরও রক্ত ক্ষরণ বন্ধ না হলে নানা ফ্যাক্টরকে সক্রিয় করে রক্ত জমাট বাঁধাতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। এখন যদি প্লেটলেটই কমে যায়, তাহলে রক্ত কীভাবে জমাট বাঁধবে আর রক্ত পড়া কীভাবে বন্ধ হবে? তাই প্লেটলেট কম থাকার কারণেও এক ধরনের পারপুরা দেখা যায়, যাকে বলে থ্রম্বোসাইটোপেনিক পারপুরা।
রক্ত জমাট বাঁধায় ব্যাঘাত :
রক্তজমাট বাঁধতে (blood clotting) হলে প্লেটলেট থেকে কিছু ফ্যাক্টর এবং রক্তের প্লাজমায় থাকা কিছু ফ্যাক্টরের অ্যাক্টিভিটি দরকার হয়। এই অ্যাক্টিভিটি স্বাভাবিক না থাকলে অনেকক্ষণ ধরে রক্তক্ষরণ হবার পরেও রক্ত জমাট বাঁধে না। ব্লিডিং টাইম স্বাভাবিক থাকলেও ক্লটিং টাইম অনেক বেড়ে যায়। নানা কারণে এই ফ্যাক্টরগুলোর কাজ ব্যাহত হতে পারে। যেমন:
- ভিটামিন কে এর অভাব: ভিটামিন কে ফ্যাক্টরগুলোর সক্রিয়তায় খুবই দরকার, বিশেষত ফ্যাক্টর ২, ৭, ৯, ১০। ভিটামিন কে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন। সবুজ শাকসবজি ( পালংশাক, পার্সলে, লেটুস পাতা, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রোকলি) এবং মাছ, মাংস, ডিম, কলিজা এসবে পাওয়া যায়। যেহেতু সে চর্বিতে দ্রবণীয় ভিটামিন, তাই অন্ত্র থেকে শোষিত হতে তার লিভার বা যকৃতের সাহায্য প্রয়োজন হয়। যখন হেপাটাইটিস, জন্ডিস, লিভার সিরোসিস এসব কারণে যকৃত ঠিকমতো কাজ করতে পারে না, তখন ভিটামিন কে এর শোষণ বাধাগ্রস্ত হয়, যা রক্ত জমাট বাধার সামগ্রিক প্রক্রিয়াকেই বাধাগ্রস্ত করে।
- হিমোফিলিয়া: যদি ক্লটিং ফ্যাক্টর নাই থাকে, তাহলে কাজ করবে কীভাবে? হ্যাঁ, হিমোফিলিয়া এমন একটি সেক্স ক্রোমোজোমাল ডিজিজ যেখানে ফ্যাক্টর ৮ আর ৯ ( অ্যান্টিহিমোফিলিক ফ্যাক্টর) এর ঘাটতি থাকে। এটি সেক্স ক্রোমোজম X মাধ্যমে বাহিত হয়, যেখানে X ক্রোমোজোম ত্রুটিপূর্ণ জিন বহন করে । পুরুষের একটিমাত্র X ক্রোমোজোমে মিউটেশন হলেই তারা এই রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু নারীদের দুটি X ক্রোমোজোম থাকায় একটি আক্রান্ত হলেও অন্যটি সুস্থ থাকে, ফলে তারা আক্রান্ত না হয়ে বাহক হয়। বিরল ক্ষেত্রে দুটো ক্রোমোজোমে মিউটেশন হয়ে নারীরাও আক্রান্ত হতে পারে। হিমোফিলিয়ার জিন বাহক নারী ও আক্রান্ত পুরুষের মধ্যে বিয়ে হলে তাদের ছেলেশিশুরা ৫০% হিমোফিলিক হবে। আর মেয়েশিশুরা ৫০% হিমোফিলিক এবং ৫০% বাহক হবে।
হিমোফিলিয়া থাকলে সার্জারির পরে, দুর্ঘটনায় এমনকি দাঁত তোলার পরেও দীর্ঘসময় রক্তক্ষরণ হতে পারে। সেরাম ফ্যাক্টর VIII বা IX অ্যাসে করে হিমোফিলিয়া শনাক্ত করা হয়৷ ফ্যাক্টর ঘাটতি পূরণ করার জন্য ইনজেকশন দেওয়া হয়।
আবার Von Willebrand factor নামক প্রোটিনের অভাবে এক ধরনের ব্লিডিং ডিজঅর্ডার হয়, যাতে ফ্যাক্টর VIII ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। একে Von Willebrand Disease বলা হয়। হিমোফিলিয়া আর ভন উইলিব্র্যান্ড ডিজিজকে একত্রে হেরেডিটারি বা বংশগতীয় ব্লিডিং ডিজঅর্ডার বলা হয়।
- ডিসএমিনেটেড ইন্ট্রাভাস্কুলার কোয়াগুলেশন (DIC) : এই রোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন টিস্যুতে হুটহাট ক্লটিং ফ্যাক্টরগুলো সক্রিয় হয়ে যায়৷ তখন বিভিন্ন জায়গার রক্তবাহিকায় রক্ত জমাট বাঁধতে থাকে। ইনজুরি হলে সেখানে রক্ত জমাট বাঁধানোর মতো ক্লটিং ফ্যাক্টর থাকে না। অবস্ট্রেটিক ডিজিজ, সেপসিস, আগুনে পোড়া এসব কারণে DIC হতে পারে।
ব্লিডিং ডিজঅর্ডার নিয়ে কিছু প্রশ্নঃ
১। হিমোফিলিয়া আর থ্যালাসেমিয়া কী এক?
না, হিমোফিলিয়াতে ক্লটিং ফ্যাক্টরের অভাবে রক্তক্ষরণ বেড়ে যায়, যেখানে থ্যালাসেমিয়াতে রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়া দেখা যায়। থ্যালাসেমিয়া রোগে হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন চেইনে অস্বাভাবিকতা দেখা যায়।
২। হিমোফিলিয়া কী শুধুই বংশগত?
এখন ২৫% ক্ষেত্রে হিমোফিলিয়া মিউটেশনের কারণে হতে দেখা যায়। বংশগতীয় বৈশিষ্ট্যের আকস্মিক ও স্থায়ী পরিবর্তনই হলো মিউটেশন। কেমোথেরাপি, অতিবেগুনি রশ্মি বা অন্য কোন কারণে জিনের অস্বাভাবিকতা ঘটে হিমোফিলিয়া হতে পারে।
৩। মেনোরেজিয়া কী ব্লিডিং ডিজঅর্ডার?
মেনোরেজিয়া বা মাসিকের সময় অত্যধিক রক্তপাতের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ের সমস্যা ও হরমোন দায়ী। মাঝে মাঝে ভন উইলিব্র্যান্ড ফ্যাক্টরের সম্পৃক্ততা থাকলেও এটিকে ঠিক ব্লিডিং ডিজঅর্ডার বলা চলে না।
Pingback: প্রোটিন গঠনের আদ্যোপান্ত : কোডিং থেকে ট্রাফিকিং - The Unspecified Chronicle