প্রোটিন গঠনের আদ্যোপান্ত : কোডিং থেকে ট্রাফিকিং

প্রোটিন কী? প্রোটিন হলো জীবনের ভাষা, আমাদের দেহাভ্যন্তরে কাজ করার জন্য Workhorse বা চলতি ঘোড়া। প্রোটিন একেবারে জীবের বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে সব ক্রিয়াকলাপে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এনজাইম, হরমোন, নিউরোট্রান্সমিটার, ট্রান্সপোর্ট প্রোটিন, অ্যান্টিবডি, রিসেপ্টর বা গ্রাহক সবকিছু হিসেবে প্রোটিন আমাদের দেহের সব কাজে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়ে চলেছে। প্রতিটি বিপাক ক্রিয়ার জন্য শরীরে আগে নির্দিষ্ট প্রোটিন তৈরি হতে হয়। প্রোটিন তৈরিতে গলদ থাকলে সংশ্লিষ্ট কাজ ঘটবেই না এবং রোগও দেখা দিতে পারে।

প্রোটিন একটি পলিমার অণু যা তৈরি হয় কমপক্ষে ১০০টি পেপ্টাইড মনোমার দিয়ে। পেপ্টাইডের মধ্যে অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো পেপ্টাইড বন্ড নামক সমযোজী বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে। প্রোটিন একবারে তৈরি হয় না, প্রথমে নির্দিষ্ট অ্যামিনো অ্যাসিড নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে সজ্জিত হয়ে পলিপেপটাইড শিকল তৈরি করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন শিকল একসাথে পেঁচিয়ে বা ফোল্ডিং এর মাধ্যমে কার্যকরী রূপ অর্জন করে।

প্রোটিন তৈরির সূচনা:

কোষে প্রোটিন তৈরির অঙ্গাণুর নাম রাইবোজোম, যারা মুক্তাবস্থায় অথবা অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক জালিকার গায়ে লেগে থাকে । তবে প্রোটিন তৈরি-পরবর্তী কাজগুলো সম্পাদনের জন্য গলজি বডি আর সাহায্যও প্রয়োজন হয়ে থাকে। প্রোটিন তৈরি করার রেসিপি বা ব্লুপ্রিন্ট থাকে ডিএনএ তে। ডিএনএ আবার থাকে নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোমে। একটা ক্রোমোজোমে একটাই ডিএনএ পাওয়া যায়। ডিএনএ থেকে মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি হয় ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায়। যে একসূত্রক আরএনএ তৈরি হয়, তাতে অনেকগুলো কোডন থাকে এবং প্রত্যেকটি কোডন একেকটি অ্যামিনো অ্যাসিডকে নির্দেশ করে। নিউক্লিয়াসে ট্রান্সক্রিপশন এর পর পোস্ট ট্রান্সক্রিপশনাল মডিফিকেশন শেষে মেসেঞ্জার আরএনএ সাইটোপ্লাজমের রাইবোজোমে চলে আসে। সেখানে তার সাথে রাইবোজোমের সাব-ইউনিট গুলো যুক্ত হয়। ট্রান্সফার আরএনএ কোডন নির্দেশিত অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো বহন করে নিয়ে আসে এবং তারা পেপ্টাইড বন্ড দিয়ে যুক্ত হয়ে পলিপেপটাইড চেইন তৈরি করে। এইভাবেই শেষ হয় আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির প্রক্রিয়া বা ট্রান্সলেশন।

প্রোটিনের স্ট্রাকচার তৈরিঃ

প্রোটিনের কাঠামো তৈরিকে চারটি ধাপে ব্যাখ্যা করা যায়।

প্রাইমারি স্ট্রাকচার :

ট্রান্সলেশন এর মাধ্যমে যে অ্যামিনো অ্যাসিডের ক্রমানুসারে পেপ্টাইড চেইন পাওয়া গেল, সেটাকেই প্রোটিনের প্রাইমারি স্ট্রাকচার বলা হয়। অর্থাৎ নিউক্লিয়াস নির্ধারিত অ্যামিনো অ্যাসিডের সিকোয়েন্স। এই চেইন বা শিকলই পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে ফোল্ডিং বা ভাঁজ হয়ে নিজের কাজ সম্পন্ন করে। প্রাইমারি স্ট্রাকচারে কোনো বিঘ্ন ঘটলে অস্বাভাবিক প্রোটিন তৈরি হয় যা মোটেও ভালো নয়। যেমন: হিমোগ্লোবিন এর প্রোটিন অংশে আলফা গ্লোবিন চেইন থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় সেখানকার প্রাইমারি স্ট্রাকচারে ৬ নম্বর পজিশনে গ্লুটামেট নামক অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। যদি গ্লুটামেটের জায়গায় ভ্যালিন এসে পড়ে তাহলে সেই গ্লোবিন চেইন হিমোগ্লোবিন -S তৈরি করে। ফলশ্রুতিতে সিকল সেল অ্যানিমিয়া দেখা যায়। রক্তের লোহিত কণিকাগুলো কাস্তে আকৃতি ধারণ করে এবং রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। সিকল সেল অ্যানিমিয়া অটোসোমের মাধ্যমে প্রজন্মে থেকে প্রজন্মে ছড়ায় আবার মিউটেশনের ফলেও হতে পারে।

সেকেন্ডারি স্ট্রাকচার :

প্রাইমারি স্ট্রাকচার তৈরি হবার পর, দুটি পলিপেপটাইড চেইন নিজেদের মধ্যে হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে পরস্পর যুক্ত হতে থাকে। একে বলে সেকেন্ডারি স্ট্রাকচার। সেকেন্ডারি স্ট্রাকচারের মধ্যে দুটো প্রধান ধরন হলো আলফা হেলিক্স আর বিটা প্লিটেড শীট।

আলফা হেলিক্স : এক্ষেত্রে পলিপেপটাইড চেইনগুলো ডিএনএ অণুর মতো পরস্পরকে পেঁচিয়ে ডাবল হেলিক্স কাঠামো তৈরি করে। একটি অক্ষকে কেন্দ্র করে অনেকটা প্যাঁচানো সিড়ির মতো উপরে উঠে যায়। প্যাঁচানোর সময় তারা নিজেদের মধ্যে প্রচুর হাইড্রোজেন বন্ধন তৈরি করে কাঠামোকে স্থিতিশীল করে। শুধু প্রথম আর শেষের অ্যামিনো অ্যাসিড বাদে বাকি সবাই হাইড্রোজেন বন্ধন গঠনে অংশ নেয়৷ কোলাজেন, অ্যাকটিন, মায়োসিন প্রোটিনে এধরনের কাঠামো দেখা যায়।

বিটা প্লিটেড শীট: এখানে পলিপেপটাইড চেইনগুলো আলফা হেলিক্সের মতো মুখোমুখি না বরং সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। প্রত্যেকটা অ্যামিনো অ্যাসিড হাইড্রোজেন বন্ধন গঠনে অংশ নেয়। গোটা কাঠামোটিকে অনেকটা ভাঁজ পড়া ফিতার মতো দেখা যায়। প্লিটেড গঠন হবার কারণ, বন্ধনে অংশ নেওয়া অ্যামিনো অ্যাসিডগুলো একেবারে মুখোমুখি না থেকে একটু ডানে-বামে বেঁকে থাকে। ইলাস্টেন প্রোটিনে এধরনের কাঠামো দেখা যায়।

টারশিয়ারি স্ট্রাকচার :

সেকেন্ডারি স্ট্রাকচার তৈরি হবার পর, পলিপেপটাইড চেইনগুলো আরো কুণ্ডলী পাকিয়ে টারশিয়ারি স্ট্রাকচার তৈরি করে। টারশিয়ারি কাঠামোকে স্থিতিশীল করতে ডাইসালফাইড বন্ড ও হাইড্রোফোবিক ইন্টারঅ্যাকশন দরকার হয়৷ এনজাইমে টারশিয়ারি কাঠামো দেখা যায়।

কোয়াটারনারি স্ট্রাকচার :

কোয়াটার্নারি স্ট্রাকচার প্রোটিন ফোল্ডিং এর একেবারে শেষ ধাপ। এখানে চেইনগুলো আরো বেশি কুণ্ডলী পাকায়, কিন্তু নিজেদের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানিক দূরত্ব বজায় রাখে। হিমোগ্লোবিন এ কাঠামোর ভালো উদাহরণ।

প্রোটিন ফোল্ডিং এর তাৎপর্য:

ফোল্ডিং ছাড়া কোনো প্রোটিনই কাজ করতে পারবে না। এজন্য ডিন্যাচারেশন প্রসঙ্গের অবতারণা করা যায়৷ যখন প্রোটিনকে উচ্চতাপ, এক্সট্রিম pH , এক্স রশ্মি, অতিবেগুনি রশ্মির সম্মুখীন করা হয়, তখন প্রোটিনের চেইনগুলোর ভাঁজ খুলে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত প্রাইমারি স্ট্রাকচার ছাড়া বাকি সব কাঠামোই হারিয়ে যায়। প্রাইমারি স্ট্রাকচার টিকে থাকে পেপ্টাইড বন্ডের কল্যাণে, যাকে এনজাইম ছাড়া কিছু দিয়েই ভাঙা যায় না। ল্যাবরেটরিতে অবশ্য এনজাইম ছাড়াই পেপটাইড বন্ড ভাঙা যায়। কীভাবে? প্রশ্নটার উত্তর পাঠকের কাছ থেকে আশা করছি।

এই যে প্রাইমারি ছাড়া বাকি সব কাঠামোই নষ্ট হলো, এই ঘটনাই হচ্ছে ডিন্যাচারেশন অব প্রোটিন। ডিন্যাচারেশন এর কারণে প্রোটিনের ধর্মতে ব্যাপক রদবদল ঘটে যায়। তার দ্রাব্যতা কমে যায়, জমাট বাঁধার প্রবণতা বেড়ে যায়, ভেদ্যতা কমে যায় ইত্যাদি। এই ধর্মের পরিবর্তনগুলোই প্রোটিনকে আমাদের জন্য সহজপাচ্য করে। রান্না করার সময় তাপে প্রোটিনের ডিন্যাচারেশন ঘটে বলে আমাদের পরিপাকতন্ত্র প্রোটিনকে ভাঙার জন্য গুটিকয়েক প্রোটিওলাইটিক এনজাইমকে দিয়েই কাজ চালাতে পারে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, প্রোটিনের ফোল্ডিং নষ্ট হলে তো সে কাজই করতে পারবে না, দেহের গঠন ও ক্ষয়পূরণ বা বিপাকে কে কাজ করবে? উত্তরটা হলো, আমরা প্রোটিন খাই অত্যাবশকীয় অ্যামিনো অ্যাসিডের ঘাটতি পূরণ করতে। আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ অ্যামিনো অ্যাসিড থাকলে তা দিয়ে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো রকমের প্রোটিন বানানো যাবে।

পোস্ট ট্রান্সলেশনাল মডিফিকেশন :

প্রোটিন তৈরি হবার পর তার জীবনচক্রে নানা রকমের মডিফিকেশন আসতে পারে। কাজ করার জন্য তার বিভিন্ন অ্যামিনো অ্যাসিডে বিভিন্ন মূলক যুক্ত করা লাগতে পারে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় পোস্ট ট্রান্সলেশনাল মডিফিকেশন, যেটি গলজি বডিতে ঘটে থাকে। যেমন : গ্লাইকোজেন ফসফোরাইলেজ একটি এনজাইম, যেটার সাথে একটা ফসফেট মূলক যুক্ত করলে সে সক্রিয় হয়ে কাজ করতে পারে। সক্রিয় হবার জন্য সে গলগি বডিতে আসবে, তারপর কাইনেজ এনজাইম ফসফোরাইলেশনের মাধ্যমে তাকে সক্রিয় করবে। আবার অনেক সময় প্রোটিনের কিছু নিষ্ক্রিয় অংশ সরিয়ে দিয়ে তাকে সক্রিয় করাও পোস্ট ট্রান্সলেশনাল মডিফিকেশন হতে পারে।

প্রোটিন ট্রাফিকিং :

তৈরি হলো, সক্রিয় হলো, এবার গন্তব্যে পৌঁছানোর পালা। এখানেও কাজ করবে কোষের ট্রাফিক পুলিশ তথা গলগি বডি। অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা থেকে বের হওয়া প্রোটিনকে মডিফাই করার পর ভেসিকলে করে প্লাজমা মেমব্রেনের দিকে পাঠিয়ে দেবে গলগি বডি। সেখান থেকে অন্য প্রোটিনের সহায়তায়, রক্তের প্লাজমায় ভেসে বা নালিকার মাধ্যমে প্রোটিন পৌঁছাবে তার গন্তব্যে। আর কোষে ব্যবহারের জন্য তৈরি হওয়া প্রোটিন চলে যাবে নির্দিষ্ট অঙ্গাণু বা কোষঝিল্লিতে।

অনেক সময় মিসফোল্ডিং এর পর যে অস্বাভাবিক বা অকার্যকর প্রোটিন তৈরি হয়, সে পরিবাহিত হতে পারে না । দেহের সার্বিক কল্যাণে তাকে বাধা দেয় অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা। যেমন : প্রোকোলাজেন থেকে কোলাজেন তৈরি ঠিকমতো হলে ব্রিটল বোন সিনড্রোম হয়, যেখানে হাড় অনেক বেশি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। এই অবস্থা প্রতিরোধে এন্ডোপ্লাজমিক জালিকা অকার্যকর প্রোকোলাজেনকে কিছুতেই পরিবাহিত হতে দেয় না। অর্থাৎ প্রোটিনের কোয়ালিটি কন্ট্রোল করার দায়িত্ব অমসৃণ এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলামের।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top