বায়োরেমিডিয়েশন : প্রকৃতির নিজের ক্ষত নিজে সারানোর হাতিয়ার

বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য মতে, পরিবেশ দূষণ প্রত্যেক বছর প্রায় ৯০ লাখ অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী। তার মধ্যে দূষিত বায়ু মৃত্যু ঘটায় ৭০ লাখ লোকের। The Daily Star এ প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, ২০২১ সালে বায়ুদূষণ কম করে হলেও ২ লাখ ৩৬ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। অর্থাৎ পরিবেশ দূষণ দিন দিন আরো প্রাণঘাতী হবার দিকে যাচ্ছে। মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি নষ্ট করছে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য, বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকে। এমতাবস্থায় এমন এক প্রযুক্তি আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে, যার মাধ্যমে পরিবেশের দূষক ও বিষাক্ত পদার্থগুলো ধবংস করার জন্য প্রকৃতির নিজস্ব বিয়োজক (এরা বাস্তুতন্ত্রে মৃত জীবদেহ বা বর্জ্য থেকে শক্তি অবমুক্ত করে) এর কার্যকারিতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই প্রযুক্তির নাম বায়োরেমিডিয়েশন। এটি একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ও শৈবালকে ব্যবহার করে পরিবেশের দূষক পদার্থকে আংশিক বা সম্পূর্ণ রূপে নিষ্ক্রিয় করে দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। টেকনিক্যালি বায়োরেমিডিয়েশন বিশেষ রকমের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি এবং কাজের দিক থেকে এখানে ব্যাক্টেরিয়ার ভূমিকাই মুখ্য, যারা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থকে ভেঙে পচনযোগ্য জৈব উপাদানে পরিণত করে।

আধুনিক বায়োরেমিডিয়েশনের পথচলা শুরু হয়েছিল একজন পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারের হাতে, যার নাম জর্জ এম রবিনসন ,সেই ১৯৬০ সালের দিকে। তবে প্রাকৃতিক বায়োরেমিডিয়েশনকে রোমান সভ্যতার লোকেরা নিজেদের সুবিধের জন্য কাজে লাগিয়েছিল। তাদের শহরগুলোতে পানি প্রবাহের নালা থাকতো, অনেক দূষিত পানি জমাও হতো। তাই তারা সেই সময় একটা সিউয়েজ সিস্টেম তৈরি করেছিল, যেখানে দূষিত পানি অনেক প্যাঁচওয়ালা গোলকধাধার মধ্যে দিয়ে গিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ফিল্টারড হয়ে আবার ব্যবহারের উপযোগী হয়ে উঠত। সময়ের তুলনায় অনেক অগ্রসর প্রযুক্তি ছিলো সেটি। রবিনসন সাহেব একালে এসে সেই প্রাকৃতিক পরিশোধনকেই কৃত্রিম পরিবেশে ঘটাতে সক্ষম হলেন, বিশেষ জাতের কিছু অণুজীব দিয়ে। তাঁর সমাধান ব্যবহার করে সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া তেল পরিষ্কার করা সম্ভব হলো।

বায়োরেমিডিয়েশন কীভাবে কাজ করে?

বায়োরেমিডিয়েশন কাজ করে মাইক্রোঅর্গানিজমের মাধ্যমে, যা পরিবেশে উপস্থিত দূষকগুলিকে ভেঙে ফেলে বা কম বিষাক্ত যৌগে রূপান্তরিত করে। মাইক্রোঅর্গানিজমগুলো মূলত দূষিত পদার্থকে তাদের নিজের শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে, যার ফলে তারা ঐ দূষকগুলিকে বিষাক্ততা কমিয়ে ফেলে বা পুরোপুরি ভেঙে দেয়। এর মাধ্যমে প্রকৃতি নিজেই তার ক্ষত সারাতে শুরু করে, এবং পরিবেশের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার হয়।

বায়োরেমেডিয়েশনের প্রকারভেদ:

বায়োরেমেডিয়েশন প্রধানত দুটি পদ্ধতিতে বিভক্ত:

  • ইন-সিটু (In-Situ)
  • এক্স-সিটু (Ex-Situ)

1. ইন-সিটু বায়োরেমিডিয়েশন:

এই পদ্ধতিতে দূষিত স্থান বা পরিবেশের ভেতরেই বায়োরেমিডিয়েশন করা হয়। অর্থাৎ, দূষণকারী পদার্থগুলোকে স্থান থেকে সরানো হয় না, বরং সেখানেই প্রাকৃতিক উপায়ে শোধন করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাটি বা পানির দূষণ দূর করার জন্য সেই জলাশয় বা ভূমিতেই অণুজীব প্রয়োগ করা হয়।

যাহোক, ইন সিটু পদ্ধতিতে খেয়াল রাখতে হয় যে-

  • সব দূষক পদার্থ বিয়োজিত হয়েছে কিনা
  • দূষিত পানি বা মাটি পরিশোধনের সময় তা কোনভাবে পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনুপ্রবেশ করছে কিনা
  • কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদ দূষণের সংস্পর্শে আসছে কিনা

2. এক্স-সিটু বায়োরেমিডিয়েশন:

এই প্রক্রিয়ায় দূষিত মাটি বা পানি সংগ্রহ করে পরিশোধনের জন্য অন্য কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে শুদ্ধিকরণ কার্যক্রম চালানো হয়।

এই দুটি পদ্ধতি ছাড়াও, বায়োরেমেডিয়েশনের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যেমন:

বায়োস্টিমুলেশন (Biostimulation): মাইক্রোঅর্গানিজমের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করার জন্য পুষ্টি বা অন্য রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয়।

বায়োঅগমেন্টেশন (Bioaugmentation): দূষণ দূর করার জন্য নির্দিষ্ট প্রজাতির অণুজীব প্রবর্তন করা হয় যা ঐ দূষণকারী পদার্থ ভাঙতে সক্ষম।

বায়োরেমিডিয়েশনের ব্যবহারক্ষেত্র:

বায়োরেমিডিয়েশন বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, বিশেষত সেখানে যেখানে প্রচলিত শোধন পদ্ধতি ব্যয়বহুল বা পরিবেশগতভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। কিছু প্রধান ক্ষেত্র নিচে তুলে ধরা হলো:

1. মাটির দূষণ দূরীকরণ: ভারী ধাতু, পেট্রোলিয়াম, রাসায়নিক সারের মতো ক্ষতিকারক পদার্থগুলো মাটিতে জমা হয়ে মাটি দূষিত করে। বায়োরেমেডিয়েশনের মাধ্যমে মাটিতে থাকা ঐ দূষকগুলিকে ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের মাধ্যমে ভেঙে ফেলা যায়, যা মাটির উর্বরতা এবং স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে।

2. পানির দূষণ শোধন: শিল্প বর্জ্য, অয়েল স্পিল (পানিতে কোনো কারণে ভারী তেল ছড়িয়ে পড়া) এবং গৃহস্থালির বর্জ্য পানি দূষণের মূল কারণ। বায়োরেমেডিয়েশন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে পানির ভেতর থেকে বিষাক্ত পদার্থগুলো (নিকেল,ক্যাডমিয়াম,মার্কারি, আর্সেনিক,লেড) সরিয়ে ফেলা হয়। বিশেষ করে ওয়েস্টওয়াটার বা ব্যবহৃত নোংরা পানিকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করার জন্য এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।

3. তেল দূষণ নিয়ন্ত্রণ: জলাশয়ে তেল ছড়িয়ে পড়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে জলজ প্রাণীর জন্য, কারণ তেল পানির উপর ভাসতে থাকায় তারা যথেষ্ট অক্সিজেন পায় না। বায়োরেমিডিয়েশন পদ্ধতি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে অগ্রণী। তেলের হাইড্রোকার্বন বিয়োজনে সক্ষম ব্যাকটেরিয়া (যেমন : Pseudomonas aeruginosa)প্রয়োগ করে এই দূষণ কমানো সম্ভব।

4. বিষাক্ত বর্জ্য এবং রাসায়নিক প্ল্যান্ট শোধন: শিল্প বর্জ্য, যেমন হেভি মেটালস, পলিউশন বা বিষাক্ত গ্যাস বাতাস ও মাটিকে দূষিত করে। বায়োরেমিডিয়েশনের মাধ্যমে এই বর্জ্যগুলিকে কম বিষাক্ত অথবা সম্পূর্ণ নিরাপদ পদার্থে রূপান্তর করা যায়। আবার কখনো কম বিষাক্ত এই বর্জ্য বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা হয় যাতে এর ক্ষতি সর্বনিম্ন মাত্রায় পৌঁছায় এবং তারপর এগুলো পরিবেশে অবমুক্ত করা যায়।

বায়োরেমিডিয়েশনের সুবিধা:

বায়োরেমিডিয়েশন প্রচলিত দূষণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির তুলনায় বেশ কিছু অনন্য সুবিধা প্রদান করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল:

1. পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি: এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনও ধরনের কৃত্রিম রাসায়নিকের ব্যবহার প্রয়োজন হয় না। ফলে পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব খুবই কম।

2. নিরাপদ এবং কার্যকর: এই পদ্ধতিতে মানবস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য কোনও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার হয় না। এই প্রক্রিয়াটি দূষণ শোধনের ক্ষেত্রে নিরাপদ এবং কার্যকর।

3. খরচ-সাশ্রয়ী: প্রচলিত দূষণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির তুলনায় বায়োরেমিডিয়েশন অনেক সাশ্রয়ী। এক্ষেত্রে অনেক সময় প্রচুর ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম প্রয়োজন হয় না।

4. বিস্তৃত প্রয়োগযোগ্যতা: বায়োরেমিডিয়েশন মাটি, পানি, বায়ু—সবক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা যেতে পারে, ফলে এটি একটি বহুমুখী দূষণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

5. দূষণ দূর করার সম্পূর্ণতা: অন্যান্য অনেক শোধন পদ্ধতিতে কেবলমাত্র দূষণ সীমিত করা হয়। কিন্তু বায়োরেমিডিয়েশন দূষণ পুরোপুরি দূর করতে সক্ষম, বিশেষত রাসায়নিক দূষণ।

বায়োরেমিডিয়েশনের সীমাবদ্ধতা:

যদিও বায়োরেমিডিয়েশন বেশ কার্যকর, তবুও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে এই প্রযুক্তির।এটি ব্যবহারের আগে ভাবতে হবে যে:

1. সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া: বায়োরেমিডিয়েশন তুলনামূলক ধীরগতির প্রক্রিয়া। দূষকগুলো ভাঙতে মাইক্রোঅর্গানিজমের কিছু সময় লাগে, তাই তাৎক্ষণিক ফলাফল পাওয়া যাবে না।

2. বিশেষ পরিবেশের প্রয়োজন: মাইক্রোঅর্গানিজমের সঠিক কাজ করার জন্য তাদের অনুকূল পরিবেশের প্রয়োজন হয়, যেমন সঠিক তাপমাত্রা, পিএইচ মান, এবং অক্সিজেন সরবরাহ। ব্যাক্টেরিয়া বা ছত্রাকের বৃদ্ধির জন্যও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা দরকার।

3. কিছু দূষণ রোধে অপারগতা : কিছু কঠিন দূষক, যেমন ভারী ধাতু বা তেজস্ক্রিয় পদার্থ, বায়োরেমিডিয়েশন প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণরূপে শোধন করা কঠিন।

বায়োরেমেডিয়েশনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা:

বায়োরেমিডিয়েশন গবেষণা এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি এবং অণুজীব ব্যবহার করে এই পদ্ধতি আরও কার্যকর এবং বিস্তৃত হতে পারে। এছাড়া, পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকায় বায়োরেমিডিয়েশন প্রক্রিয়া আরও বেশি জনপ্রিয় এবং প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে।

বিশেষ করে জিন প্রকৌশল (Genetic Engineering) ব্যবহার করে মাইক্রোঅর্গানিজমের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে, যা দূষণমুক্তকরণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে। উদাহরণস্বরূপ, মাইক্রোঅর্গানিজমের জিন পরিবর্তন করে তাদের বিশেষ বিশেষ দূষকের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর করা হচ্ছে।

সবশেষে, বায়োরেমিডিয়েশন প্রাকৃতিকভাবে পরিবেশের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি টেকসই উপায়, যা ভবিষ্যতের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে গবেষণা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে এসব সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করা সম্ভব।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top