পাওয়ারপয়েন্ট এ পড়াতে গেলে যেসব বিষয় মাথায় রাখতেই হবে

ক্লাসরুম কিংবা কনফারেন্স রুম, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন এর জয়জয়কার সর্বত্র। পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড তথ্য উপস্থাপন ও দর্শক-শ্রোতাদের সাথে যোগাযোগের শক্তিশালী মাধ্যম। স্লাইডে সুদৃশ্য উপস্থাপনার পাশাপাশি উপস্থাপকের বক্তৃতা শ্রোতাকে তথ্য হৃদয়ঙ্গম করাতে খুবই সহায়ক। বিশেষত শ্রেণিকক্ষে পাওয়ারপয়েন্ট শুধু পড়ানোর একটি মাধ্যমই নয়, বরং ইন্টারঅ্যাকটিভ লার্নিং এর ক্ষেত্র। প্রচলিত লেকচারের চেয়ে পাওয়ারপয়েন্ট এর ক্লাস শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর দ্বিমুখী যোগাযোগ আর শিক্ষার্থীদের সক্রিয় শিখনের জন্য অনেক বেশি সহায়ক।বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহ বাড়াতে, বিষয়বস্তু সহজে বুঝতে সহায়তা করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উপর ফোকাস করতে সাহায্য করে।

পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার করতে হবে কায়দামতো।

পাওয়ারপয়েন্ট কী?

এর উত্তর সবার জানা। মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট হলো একটি জনপ্রিয় প্রেজেন্টেশন সফটওয়্যার, যা ব্যবহারকারীদের প্রেজেন্টেশন তৈরি, সম্পাদনা এবং প্রদর্শনের সুযোগ দেয়। এটি ১৯৮৭ সালে প্রথম বাজারে আসে এবং বর্তমানে মাইক্রোসফট অফিসের অংশ। পাওয়ারপয়েন্টে ব্যবহারকারী টেক্সট, ছবি, ভিডিও, এবং অ্যানিমেশন সহ বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া সংযুক্ত করতে পারে, যা প্রেজেন্টেশনকে আরও আকর্ষণীয় এবং তথ্যবহুল করে তোলে। সফটওয়্যারটি বিভিন্ন টেমপ্লেট এবং ডিজাইন অফার করে, যা ব্যবহারকারীদের তাদের প্রেজেন্টেশনকে দ্রুত সাজাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, পাওয়ারপয়েন্টে স্লাইড শো ফিচার আছে, যা প্রেজেন্টেশন চলাকালীন দর্শকদের সামনে স্লাইডগুলো উপস্থাপন করতে সহায়তা করে। এটি শিক্ষাগত, ব্যবসায়িক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

পাওয়ারপয়েন্ট কি শিখন বাড়াতে সহায়ক?

এবিষয়ে Hossein Nouri এবং Abdus Shahid নামক দুজন গবেষক একটি নিরীক্ষা করেন, যার প্রতিপাদ্য ছিল শিখন ও মনোভাবের উপর পাওয়ারপয়েন্টের প্রভাব। তাঁরা মূলত দেখতে চেয়েছিলেন যে কীভাবে পাওয়ারপয়েন্ট শর্ট টার্ম মেমোরি, লং টার্ম মেমোরি আর ক্লাসের ব্যাপারে শিক্ষার্থীর মনোভাবকে প্রভাবিত করে।

শিখন দক্ষতার ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। শিক্ষার্থীদের একদলকে পাওয়ারপয়েন্ট সহযোগে এবং আরেকদলকে প্রচলিত পদ্ধতিতে পড়ানো হলো। যেসব চ্যালেঞ্জিং বিষয়ের সমাধান করতে ডিসকাশন বা আলোচনা করতে হয়, সেসব বিষয়ের কুইজে পাওয়ারপয়েন্টের শিক্ষার্থীরা ভালো করল।আর যেসব সমস্যার সমাধান স্টেপ বাই স্টেপ করতে হয়, সেখানে প্রচলিতভাবে পড়ানো শিক্ষার্থীরা এগিয়ে গেল। লং টার্ম মেমোরির ব্যাপারে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া যায়নি, দুই গ্রুপের শিক্ষার্থীদের ফলাফলে প্রায় কোনো পার্থক্য ছিল না।

কিন্তু পাওয়ারপয়েন্ট শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণকে অনেকটাই প্রভাবিত করেছিল। পাওয়ারপয়েন্টে পড়ানো শিক্ষার্থীরা তাদের পড়া সহজেই বুঝতে পারছিল এবং তারা মনে করছিল যে তাদের শিক্ষক পড়ানোর জন্য অনেক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন।এই ব্যাপারটা অন্য গ্রুপের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যায়নি। মজার ব্যাপার হলো, পাওয়ারপয়েন্ট শিক্ষার্থীদের খুব বেশি দিন আকৃষ্ট করে রাখতে পারেনি। সেমিস্টারের শেষের দিকে পাওয়ারপয়েন্ট শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর জনপ্রিয় ছিল না।

এই নিরীক্ষা থেকে বোঝা গেল যে,যতই আকর্ষণীয় করে স্লাইড বানানো হোক না কেন, পাওয়ারপয়েন্ট শিক্ষার্থীদের খুব বেশি সময় উদ্ধুদ্ধ করে রাখতে পারে না। তবে নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য পাঠ্য বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ বাড়িয়ে দিতে পারে। শিক্ষক যদি সেটুকু সময়ের সদব্যাবহার করতে পারেন তাহলেই পাওয়ারপয়েন্ট বানানো সার্থক। কারণ টার্ম, ইয়ার বা সেমিস্টার শেষে যখন অনেক পড়া একসাথে পড়তে হয় তখন পড়া মনে রাখার বিষয়টি প্রাধান্য পায়, স্লাইডের সৌন্দর্য তখন শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে পারে না।

কী কী বিষয়ে খেয়াল রেখে স্লাইড বানাতে হবে?

এজন্য একজন শিক্ষক যখন পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড তৈরি করবেন, তিনি নিম্নোক্ত বিষয়াদি বিবেচনা করতে পারেন:

  1. স্লাইডের মিনিমাল ডিজাইন : স্লাইড তৈরির ক্ষেত্রে পরিমিত ডিজাইন গুরুত্বপূর্ণ। স্লাইডে বেশি তথ্য না দিয়ে বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ের প্রয়োজনীয় তথ্য সংক্ষেপে উল্লেখ করা উচিত। শিক্ষকেরা স্লাইডে ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করবেন যাতে শিক্ষার্থীরা দ্রুত এবং সহজে তা বুঝতে পারে। এছাড়াও, ফন্টের আকার ও রঙ যথাযথভাবে নির্বাচন করলে স্লাইডটি পড়তে। ও বুঝতে সুবিধা হয়।
  2. ভিজ্যুয়াল এলিমেন্ট যোগ করা: স্লাইডে ভিজ্যুয়াল এলিমেন্ট যেমন ছবি, গ্রাফ, চার্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা উচিত। বিশেষ করে জটিল বিষয়বস্তুকে সহজে বোঝানোর জন্য গ্রাফিক্স খুবই কার্যকর। তবে খেয়াল রাখতে হবে, স্লাইডে যেন অতিরিক্ত ভিজ্যুয়াল না থাকে কারণ এতে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  3. ইন্টারঅ্যাকটিভ উপাদান সংযুক্তি : প্রেজেন্টেশনে ইন্টারঅ্যাকটিভ উপাদান যোগ করা শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকের দ্বিমুখী সংযোগ বজায় রাখতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রশ্নোত্তর সেশন, কুইজ বা গ্রুপ ডিসকাশন স্লাইডে সংযুক্ত করলে শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে শেখার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধি পায়।
  4. মূল পয়েন্টগুলো হাইলাইট করা: শিক্ষার্থীরা যাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা মূল পয়েন্টগুলো সহজে মনে রাখতে পারে সেজন্য সেগুলো স্লাইডে হাইলাইট করা উচিত। এটি কেবলমাত্র মনোযোগ বৃদ্ধি করেনা , বরং শিক্ষার্থীদের মনে করতে সহায়তা করে যে কোন বিষয়গুলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
  5. পাঠ্য বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা: স্লাইড তৈরির সময় শিক্ষকের উচিত বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্লাইডের কন্টেন্ট তৈরি করা। প্রেজেন্টেশনের প্রতিটি স্লাইড যেন নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর ফোকাসড থাকে এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সহজবোধ্য হয়। প্রেজেন্টেশনের স্লাইডগুলো যদি নির্দিষ্ট ধারণাকে তুলে ধরে এবং বিষয়টিকে আরও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে তাহলে তা সহজেই শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে।

স্লাইডের সাফল্যে করণীয়:

পাওয়ারপয়েন্ট স্লাইড এতোটা সময় ধরে তৈরি করা উচিত নয়, যার ফলে শিক্ষক লেকচারের প্রস্তুতি নিতে পারেন না। ভালোমানের স্লাইড বানিয়ে শিক্ষক যদি শুধু ক্লাসে সেগুলো রিডিং পড়ে যান, তাহলে শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড বিরক্ত হয়। একটানা স্লাইড পড়ে গেলে ক্লাস প্রচণ্ড বোরিং হয়, পাঠ্য বিষয়ে শিক্ষার্থীর আগ্রহ একেবারে তলানিতে পৌঁছে যায়। স্লাইডে যতটুকু লিখতেই হবে, ততটুকু লিখে বাকিটা ব্যাখ্যা করা উচিত। নিদেনপক্ষে আগে ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে পরে স্লাইড দেখালেও তা কাজ দেয়। কিন্তু ক্লাসে শুধু স্লাইড পড়ে গেলে তা খুবই নেতিবাচকতা সৃষ্টি করে।

সবশেষে মনে রাখা উচিত পাওয়ারপয়েন্ট প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির বিকল্প নয়, পরিপূরক মাত্র। প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির সাফল্যের হার বাড়াতে তা সাহায্য করে। তাই ভালোমতো পড়ানোর জন্য স্লাইডের সঠিক ব্যবহার ও নিজের উপস্থাপন দক্ষতার মিশেল ঘটানো জরুরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top