স্থূলতা বা obesity কী?
স্থূলতা (Obesity) এমন একটি ডিজঅর্ডার, যা আমাদের দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণের সিস্টেমগুলোর অকার্যকারিতার ফলে দেখা দেয়। শরীরে ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে ২০% বেড়ে গেলেই তাকে স্থূলতা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।
স্থূলতার সাথে পুষ্টির একটি সম্পর্ক আছে। আমরা যে খাদ্য গ্রহণ করি, তা কীভাবে স্বাস্থ্য বজায় রাখতে কাজে লাগে সেই জ্ঞানই হলো পুষ্টি বা nutrition। ইংরেজি malnutrition শব্দ শুনলে সকলে একে পুষ্টির অভাব ধরে নেয়। কিন্তু malnutrition অপুষ্টি এবং অতিপুষ্টি, দুটো বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সে হিসাবে, obesity এক ধরনের malnutrition।
Table of Contents
Obesity কেন হয়?
জিনগত কারণে: obesity মাল্টিফ্যাক্টরিয়াল জেনেটিক ডিজঅর্ডার। দেখা গেছে যে, পিতা ও মাতা উভয়ই স্থূল হলে সন্তানের স্থূল হবার সম্ভাবনা থাকে ৭৫%। আর পিতা ও মাতা স্থূল না হলে সে সম্ভাবনা মাত্র ৯%।
মিউটেশন: জিনে মিউটেশন হলে লেপটিন হরমোন তৈরি বাধাগ্রস্ত হয়। লেপটিন আমাদের প্রয়োজনমাফিক খাদ্য গ্রহণের সংকেত মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। তখন মস্তিষ্ক অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়। লেপটিন তৈরি না হলে মস্তিষ্ক সংকেত পায় না এবং মানুষ ক্রমাগত প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করতেই থাকে।
গর্ভাবস্থা: গর্ভাবস্থায় নারীর ওজন স্বাভাবিকের ২০% এর চেয়ে বেড়ে গেলে তাকে maternal obesity বলে। সন্তান প্রসবের পর এ মেদ ঝরিয়ে ফেলা যায়।
ওষুধ :স্টেরয়েড, অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট, অ্যান্টি কনভালসেন্ট ড্রাগ স্থূলতার জন্য দায়ী হতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা: অতিরিক্ত ক্যালরি বার্ন না করলে তা জমা হতে হতে স্থূলতায় রূপ নেয়। সারাদিন ডেস্কজব করা, শুয়েবসে সময় কাটানো, কম বা একেবারেই না হাঁটা obesity এর ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
হরমোনজনিত সমস্যা: থাইরয়েড বা অন্যান্য হরমোনজনিত সমস্যা থাকলে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। মানসিক চাপ বা পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যা খাদ্যের প্রতি অস্বাভাবিক আকর্ষণ বাড়ায়।
স্থূলতা যেসব রোগের জননী:
ডায়াবেটিস যেমন জটিল রোগের জননী, স্থূলতাও সেরকম অনেক স্বাস্থ্যসমস্যার গোড়া হয়ে উঠতে পারে। যেমন:
- উচ্চ রক্তচাপ
- স্ট্রোক
- হার্ট ফেইলিউর
- শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি
- অস্টিওআর্থ্রাইটিস, গাউট (গেঁটেবাত)
- গর্ভাবস্থায় খিঁচুনি, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস
- পিত্তথলির পাথর
- ফ্যাটি লিভার ডিজিজ
- ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স ( ইনসুলিন হরমোনের প্রতি দেহকোষ সাড়া দেয় না, তার কাজ ব্যহত হয়)
- ডায়াবেটিস মেলিটাস
- হাইপোথাইরয়েডিজম
- হাইপোগোনাডিজম
- অনিয়মিত রজ:চক্র
- বন্ধ্যাত্ব (infertility)
- কোলন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার
- স্তন ক্যান্সার
- মানসিক অবসাদ প্রভৃতি।
স্থূলতার পরিমাপ:
BMI:
আপনি স্থূল কি স্থূল নন, তা জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে BMI বা বডি মাস ইন্ডেক্স বের করা। শরীরের ওজন কেজিতে মেপে উচ্চতার (মিটার এককে) বর্গ দিয়ে ভাগ করলেই পেয়ে যাবেন BMI। এখন মোবাইল ফোন বা স্মার্ট ওয়াচের ক্যালকুলেটরে BMI বের করার ফাংশন থাকে। ওজন ও উচ্চতার তথ্য দিলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে BMI বের হয়ে যায়। BMI পুষ্টির সূচক হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিচের চার্ট দেখে আপনার পুষ্টির অবস্থা মিলিয়ে নিন:
BMI এর মান | অবস্থা |
<18.5 | কম ওজন |
18.5-24.9 | আদর্শ ওজন |
25-29.9 | অতিরিক্ত ওজন |
30-39 | obesity |
>40 | মরবিড বা মৃত্যুঝুঁকিপূর্ণ obesity |
Waist-hip ratio:
আপনার কোমর আর হিপের মাপের অনুপাত নির্দেশ করে আপনি স্থূল কি না। পুরুষের জন্য স্বাভাবিক অনুপাত ১ এবং নারীদের জন্য ০.৮৪। এর চেয়ে বেশি হলেই তাকে স্থূলতা বা obesity বলতে হবে।
Waist Circumference :
সোজা কথায় কোমরের মাপ। পুরুষের জন্য স্বাভাবিক মাপ ৯৪ সে.মি. এবং নারীদের জন্য তা ৮০ সে.মি.। এর বেশি হলেই স্থূলতা দেখা দেয়। মাত্রাতিরিক্ত স্থূলতায় এই মান পুরুষের জন্য ১০২ এবং নারীদের জন্য ৯৪ সে.মি. ছাড়িয়ে যায়।
স্থূলতার মধ্যে ভালো-খারাপ আছে?
অবশ্যই। আমাদের দেহে মূলত দুই জায়গায় দৃশ্যমান চর্বি জমা হয় : অ্যাবডোমেন (পেট) এবং গ্লুটিয়াল রিজনে (উরু ও পশ্চাদ্দেশ)। পেটে চর্বি জমা তূলনামূলক খারাপ, কারণ এই চর্বি বেশি বেশি ভেঙে রক্তে প্রচুর ফ্যাটি এসিড ছড়িয়ে দেয় এবং ধমনীর গায়ে ফ্যাট জমার সম্ভাবনা বাড়ায়।
স্থূলতা প্রতিরোধ:
স্থূলতা প্রতিরোধের জন্য সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। নিচে কিছু কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা উল্লেখ করা হলোঃ
1. সুষম খাদ্য গ্রহণ:
- প্রতিদিনের খাবারে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও চর্বির অনুপাত হওয়া চাই ৪:১:১।
- চর্বির উৎস হিসেবে ওমেগা-৩, ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৯ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাদ্য বেছে নেওয়া ভালো। সূর্যমুখী তেল, বাদাম তেল, ক্যানোলা তেল, ডিমের কুসুম ও মাছের চর্বিতে এগুলো পাওয়া যায়।
- ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্যতালিকায় ডায়েটারি ফাইবার রাখতে হবে। ফাইবার জাতীয় খাদ্য পাকস্থলীকে পূর্ণ করে কিন্তু ক্যালরি দেয় না। অধিকন্তু চর্বি শোষণেও বাধা দেয়৷ পুরুষের দিনে ৩৮ গ্রাম এবং নারীদের দিনে ২৫ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার গ্রহণ করা উচিত। শাকসবজিতে প্রচুর ডায়েটারি ফাইবার থাকে।
2. নিয়মিত ব্যায়াম :
প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম করা উচিত। যোগব্যায়াম বা সাঁতারও ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
3. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করা:
প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম শরীরের বিপাক ক্রিয়া সঠিক রাখে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
4. মানসিক চাপ কমানো:
মানসিক চাপ কমানোর জন্য ধ্যান, শখ পূরণ বা মনোরঞ্জনমূলক কাজ করা যেতে পারে।
5. স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো:
নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার মাধ্যমে হরমোনজনিত সমস্যা বা অন্যান্য কারণ চিহ্নিত করে সমাধান করা যেতে পারে।
স্থূলতা একটি প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রম এবং মানসিক সুস্থতা বজায় রেখে এটি এড়ানো সম্ভব। স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, কারণ এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নয়, বরং সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপরও প্রভাব ফেলে। সুতরাং, একটি স্বাস্থ্যকর জীবনধারাই হতে পারে স্থূলতার সর্বোত্তম প্রতিরোধ।